একটি শব্দার্থের খোঁজে

Author

কালেরতরী

২১ নভেম্বর , ২০২১ ( রবিবার ) ১১:৩১

একটি শব্দার্থের খোঁজে

                 -ফাতিহুল কাদির সম্রাট

 

মনোরঞ্জন ব্যাপারী নাম তাঁর। তিনি একজন লেখক। সম্প্রতি তার বইয়ের অনলাইন ভারসন বাজারজাত করার জন্যে ই-কমার্স জায়ান্ট ‘অ্যামাজন-এর সাথে চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী ‘অ্যামাজন তাঁকে এত এত টাকা দিয়েছে যে, তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী তিনি তিনদিনেও সে টাকা গোনে শেষ করতে পারবেন না। এক সময় একমুঠো অন্যের জন্যে চুরি ছেঁচড়ামি যাঁকে করতে হয়েছে তাঁর লেখক ও বিত্তশালী হয়ে উঠার পেছনে রয়েছে চমকপ্রদ কাহিনি। একটি শব্দের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে বদলে গিয়েছিল মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জীবনের সকল ব্যাপার।

মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জন্ম ১৯৫০-এ, বাংলাদেশের বরিশালে, হিন্দু নিম্নবর্ণ শ্রেণিতে। দেশভাগপরবর্তী সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও পাক-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর পরিবার উদ্বাস্তুরূপে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ বলে তাঁর পরিবারের জায়গা হয় না সাধারণের আশ্রয় শিবিরে। ভারত সরকার তাদের ‘দণ্ডকারণ্য-এ নির্বাসনে পাঠাতে চায়। মনোরঞ্জনের বাবা তাতে রাজি হন না। ফলে উদ্বাস্তুদের জন্যে বরাদ্দ ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হন তাঁরা। পথের পাশে ঝুপড়িতে শুরু হয় তাঁদের মানবেতর জীবনের যুদ্ধ। দীঘল চুল ছিল মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মায়ের। তেলের অভাবে মাথায় জট বেঁধে যায় তাঁর। চুল কামিয়ে ফেয়ে জটজ্বালা থেকে মুক্তি পান তিনি। ব্যাপারীর  শিশু ছোটোবোনটি অনাহারে মারা যায় সবার চোখের সামনে। অনাহার ও অপদ্রব্য ভক্ষণে আলসারে মারা যান মনোরঞ্জনের বাবা। পথশিশুর ভাগ্যবরণ করতে হয় মনোরঞ্জন ব্যাপারীকে। রেল স্টেশনের টোকাই হয়ে যান তিনি। রেল পুলিশেরা তাদের চাকরির উন্নতির নিমিত্ত তাকে প্রায়ই কারণে অকারণে জেলে পুরত। জেলে যাওয়া আসার এই খেলায় তিনি একবার ফেঁসে গেলেন বড় মামলায়। ছয় থেকে দশ বছরের জেল হওয়ার শঙ্কায় পড়ে যান তিনি। জেলে পরিচয় হয় একজন জ্ঞানী ও পড়ুয়া মানুষের সাথে, যিনি ছিলেন ফর টুয়েন্টি ধারার আসামি। লোকটি কিশোর মনোরঞ্জনকে স্নেহ করতেন।

জেলখানায় আর সবার মতোই ব্যাপারীকে নানা কাজে খাটতে হতো। সাজা শেষ হওয়ার প্রাক্কালে সেই লোকটি বলেন, ‘তোর তো অনেকদিন জেলে থাকতে হবে। এভাবে খাটলে জেলেই মরে যাবি। কয়েদিদের নাম ডাকার মতো সহজ কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না দেখি। মনোরঞ্জন জানান, তিনি নিরক্ষর। এমন কাজ কীভাবে করবেন তিনি? লোকটি বলেন, পড়ালেখা শেখার ইচ্ছা থাকলে উপায় হবেই। তিনি দাঁতনের ডাল দিয়ে জেলখানার মেঝেতে বর্ণ লিখে মনোরঞ্জনকে শেখাতে থাকলেন ‘অ ‘আ ‘ক ‘খ। বর্ণ পরিচয়ের সাথে সাথে মনোরঞ্জনের মন রঞ্জিত হতে থাকল এক অজানা আনন্দে। তাঁর সামনে খুলে গেল এক আলোক-উদ্ভাসিত জগতের দুয়ার।  বই পড়ার নেশায় পেয়ে বসল তাঁকে।

জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বেঁচে থাকার জন্যে রিকশা চালানো শুরু করেন মনোরঞ্জন ব্যাপারী। বইপড়ার নেশাটা আরো প্রবল হয়েছে তখন। রিকশার সিটের নিচে থাকে নানান বই। এক বই পড়তে গিয়ে তিনি পেলেন এমন একটি শব্দ যার মানে তিনি জানেন না। একদিন বিজয়গড় কলেজের সামনে থেকে এক মহিলা সওয়ারি হলেন রিকশায়। মনোরঞ্জনের ধারণা হলো তিনি কলেজের শিক্ষক হবেন।  তিনি হয়তো জানতে পারেন সেই শব্দার্থ। বিনয়ের সাথে সওয়ারির কাছে রিকশাচালক মনোরঞ্জন ব্যাপারী জানতে চাইলেন সেই শব্দের অর্থ। আরোহিণী বেশ আশ্চর্য হলেন। তিনি বললেন, ‘তুমি এই শব্দ পেলে কই?’ ব্যাপারী বলেন, ‘বই পড়ে। সওয়ারি আরো বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি বই পড়ো?’ ব্যাপারী রিকশার সিট উপড়িয়ে দেখান বইয়ের সঞ্চয়। যেখানে ছিল ঐ সওয়ারির নিজের লেখা ৭-৮টি বই। শব্দার্থ বলে দিয়ে সওয়ারি জানতে চাইলেন ব্যাপারীর লেখার অভ্যাস আছে কি-না। ব্যাপারী পড়েন বটে, কিন্তু কখনো কলম ধরেননি। তাই উত্তর দিলেন ‘না। সওয়ারি বললেন, ‘ইচ্ছাটাই বড়। চেষ্টা করো, পারবে। তিনি আরো বললেন, তিনি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন যাতে অন্ত্যজ শ্রেণির পিছিয়ে পড়া মানুষ ও অখ্যাত লেখকদের লেখা ছাপা হয়। রিকশা থেকে নামার আগে সওয়ারি তাঁর নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে গেলেন চিরকুটে।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী কলম ধরলেন। লেখা তৈরি হলো।  সেটি পাঠিয়ে দিলেন সওয়ারির ঠিকানায়। যথারীতি লেখাটি ছাপা হলো। একজন সম্ভাবনাময় লেখক নিজের আগমনী বার্তা দিলেন। লেখক-পাঠক ও বিদ্বৎসমাজ চমকিত হলো। মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মনে ‘আমিও পারি এই বিশ্বাসটি জেগে উঠল। তিনি লেখা শুরু করলেন। একটি শব্দার্থ খোঁজার প্রয়াসে তিনি হয়ে গেলেন শব্দশিল্পী। তাঁর হাত ধরে বাংলা কথা সাহিত্যে অন্ত্যজ ও দলিত শ্রেণির দুঃখপীড়িত এবং বঞ্চনাকাতর জীবনের বাস্তব ছবি জায়গা করে নিল। তাঁর বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন  (১ম পর্ব ও ২য় পর্ব), অন্য ভুবন, বৃত্তের শেষ পর্ব, জিজীবিষার গল্প, চণ্ডাল জীবন, বাতাসে বারুদের গন্ধ, অমানুষিক, গল্প সমগ্র (১ম ও ২য় খণ্ড), মতুয়া এক মুক্তি সেনা, মরণ সাগর পারে, তোমরা অমর ইত্যাদি। ২০২১ সালের বিধান সভার নির্বাচনে তিনি হুগলির বালাগড় আসন থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন।

যে শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে লেখক মনোরঞ্জন ব্যাপারীর জন্মের সূচনা সেই শব্দটি ছিল ‘জিজীবিষাযার অর্থ বেঁচে থাকার ইচ্ছা। আর সেই সওয়ারি ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক ও মানবাধিকার কর্মী মহাশ্বেতা দেবী। মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম জন্ম ঢাকায়। তাঁর বাবা বিখ্যাত সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী মণীশ ঘটক, স্বামী খ্যতিমান নাট্যকার ও নাট্যকর্মী বিজন ভট্টাচার্য এবং পুত্র নবারুণ ভট্টাচার্যও একজন খ্যাতিমান কবি। মহাশ্বেতা দেবী ২০১৬ সালে মারা যান।

আর্কাইভ