কুলি
কুলি
হোসনেয়ারা বেগম
কমলাপুর রেলস্টেশন, রাত্র দ্বিপ্রহর, দাঁড়িয়ে আছি অনেকক্ষণ, গন্তব্য চিটাগং। ট্রেন আসতে বাকী নাই বেশিক্ষণ, কেবল মনে হয় দেরি হয়ে যাবে। সাথে আছে লাগেজ পত্র। হঠাৎ শুনি হাক ডাক কুলিদের সরগরম, আমিও ব্যস্ত হলাম। এই, এদিকে একজন আসো তো দেখি। অবাক ব্যপার দৌড়ে এসেছে ছোট্ট একজন, বয়স অনুমান করা মুস্কিল তবে বড়ো জোড় দশ বারো হবে হয়তো। বললাম আরে দুর তোকে কে ডাকছে বল তো? সে বললো কেন মুটে বইবো না ? এতোগুলো ভারি লাগেজপত্র তুই নিতে পারবিনারে, বড় একজনকে ডেকে নিয়ে আয়। ও চোখ বড়ো করে বললো, কি যে কন খালাম্মা, এই বোঝা লইতে আবার কারে ডাহুম ? আফনি কোন চিন্তা নিয়েন না, ট্রেন আইলে হক্কলের আগে ট্রেনে লাগেজ তুইল্লা দিমুনে। ট্রেন ঠিক টাইমে আসবে তো ? না গো খালাম্মা হেই কথা কওন যায় না। দেহন গেছে রাইত দুইটার ট্রেন ভোর পাঁচটাও আহে না, তয় আবার কোন কোন সময় ঠিক সময়ও আহে। আফনে চিন্তা কইরেন না, আমি এহানে আছি। ট্রেন আসছে না পরক্ষণে জানলাম লাইনে সমস্যা হইছে, ট্রেন আসতে ভোর হবে। ওকে বললাম ট্রেন তো এখন আসছে না তুই এখন যা। আমার উদ্দেশ্য ওগেলেই ভালো পরে একজনকে ঠিকভাবে ডেকে নেব। খালাম্মা হেই কথা অইবে না আমি আফনে গো লাগেজ তুইল্লা দিয়া তয় যামু। কি আর করা, বললাম একটু চা খাওয়াতে পারবি ? কেন পারুম না অহনি আমি ভালো দোহানে গিয়ে চা আইন্না দিতেছি।
চা খেতে খেতে ওকে জিজ্ঞেসা করলাম। এই তোর নাম কিরে ? ও আমাকে অবাক করে উত্তর দিলো কুলি। দূর কুলি আবার কারো নাম হয় নাকি ! খালাম্মা ধরেন হেই জন্মের পর অইতে এহানে আছি, সবাই তো এই নামেই ডাহে। হি..হি... আর কোন নাম আছিল কিনা হেইডা ভুইল্লা গেছি। তোর বাড়ী কোথায়? কেন রেলস্টেশন। তোর বাবা মা কোথায় ? হেইয়া মুই জানিনা। কি মুস্কিল তুই এতো হেয়ালি করে কথা বলিস কেন। না খালাম্মা যা সত্য হেইয়াই কই। মোর বাবা মা কেডা হেইঢা সত্যি মুই জানিনা। তয় এহানে মোর এক বুড়ী মা আছে, হে মোরে গেদু কইয়া ডাহে। হে কইছে কেডা জানি মোরে জন্ম দিয়া হালাইয়া গেছে, হেরপর বুড়ী মায় পাইল্লা বড় করছে। জানেন খালাম্মা, মুই এহানের দাগ নম্বর দেওয়া কুলি না। এই ধরেন যে, আফনে মোরে একশো টাহা দিলে মুই পামু খালি বিশ টাহা। বাকী টাহা নেবে সরদার। তুই এতো কষ্ট করে লাগেজ টানবি টাকা সরদার নেবে কেন? এইডা এহানের নিয়ম, টাহা না দিলে মাল টানতে দিবেনা, উল্ডা মাইরা বাইর কইরা দিব। ওর সাথে কথা বলতে বলতে ট্রেন এসে গেছে। আবাক বিষ্ময়কর ভাবে আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। সত্যি দেখলাম ওর ওজনের চেয়ে ওর বোঝার ওজন বেশি হবে। ও অনায়াসে তা নিয়ে ট্রেনে উঠলো। আমি ওকে একটু বেশি টাকা দিলাম। ও প্রথমে নিতে চায় নি, পরে দেখলাম খুব খুশি। আফনে খুব ভালো খালাম্মা এই বেশি টাহা দিয়া বুড়ীমার লইগ্যা মাছ নিমু। হে খালি কয়দিন ধইরা মাছের কথা কয়। ট্রেন হুইসাল দিতেছে ও নেমে গেল। আমি ওর গন্তব্যের দিকে তাকিয়ে আপনা থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। হ্যায়রে জীবন! ওরা বেঁচে মরে, মরনেই শেষ হয় ওদের জীবনের গল্প। একজন কুলির জীবন যেনো হাজারো কুলির জীবনের ইতিকথা।