বিসর্জন-অর্জনের ৫০ বছর । মোঃ মনির হোসেন
বিসর্জন-অর্জনের
৫০ বছর
-মোঃ মনির হোসেন
আজ থেকে ৫০ বছর
আগে দীর্ঘ নয় মাসের রক্ত ঝড়ানো মুক্তিযুদ্ধের পর
ঠিক এমনই একটি দিনে আমরা অর্জন করেছিলাম মহান স্বাধীনতা।নিজের একটি দেশ,নিজের একটি পতাকা লাভ করতে আমাদের কতো প্রাণ,
কতো মা-বোনের ইজ্জত,
কতো সহায়-সম্পদ অকাতরে
বিলিয়ে দিতে হয়েছিল তার ইতিহাস বিশাল।তখন ছিলাম মাত্র তিন চার বছরের বালক।আমার
পৃথিবীটা ছিল কাগজের নৌকা বানিয়ে পুকুর ঘাটে ভাসানো,সুপারি গাছের খোলে সঙ্গীদের বসিয়ে ডগায় টেনে
গাড়ি গাড়ি খেলা, চাচার কাছে বড়
একটা ঘুড়ি বানিয়ে দেবার আবদার,দলবেঁধে বিলে
গিয়ে ক্ষেতের আইলের ফাঁদে পড়া অসহায় ছোট মাছগুলো ধরে আনা,প্রতিদিন সকলে মিঞাসাবের মক্তবে হাজির হওয়া,পড়া না পারলে কানমলা,বেতের কষাঘাত এসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যুদ্ধ,স্বাধীনতা,নিজের দেশ,নিজের পতাকা এসব বিষয় বুঝতে তখনো সক্ষম হয়ে উঠি
নি।তবে পাড়ায় পাড়ায় বড়রা যখন জয় বাংলা মিছিল করেছেন তখন কাগজের পতাকা নিয়ে তাদের
পিছু পিছু দৌড়ে গেছি এটা ভালোই মনে আছে।এটাও আমার মতো অসংখ্য বাঙালি শিশুদের একটি
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।কেননা তখন আমাদের পৃথিবীটা ততটুকুই ছিল।
আজ মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, অর্থাৎ স্বাধীনতার ৫০ বছরে পা রাখলাম আমরা।শুধু
তাই নয়,আজ ইতিহাসের এক স্মরণীয়
দিন বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী।১৯৭১ সাল বা তার পূর্ববর্তী সময়ে যারা অকাতরে
নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে আমাদের জন্য একটি স্বপ্নের স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে
গেলেন তাদের সেই স্বপ্ন,সেই ত্যাগ কতটুকু
কার্যকর বা সফল হয়েছে এখন তা হিসাব করে দেখার পালা আমাদের।মহান মুক্তিযোদ্ধাগণ কোন
চেতনায় বিশ্বাসী হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন,কী পাওয়ার আশায় সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন,আর তাদের সেই চেতনা বা চাওয়া কতটুকু বাস্তবায়ন
হলো এর হিসাব মেলানোই বর্তমান প্রজন্মের আসল কাজ।স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের তো নতুন
কিছু করবার নেই,এর চেতনা,লক্ষ্য সবকিছুই বঙ্গবন্ধু স্থির করে
গিয়েছেন।আমরা যুগে যুগে শুধু তার বাস্তবায়ন করব।যে লক্ষ্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু
স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন,তিনি যেসব মূলমন্ত্র আমাদের সংবিধানে রেখে গেছন তার কতটুকু আমরা বাস্তবায়ন
করতে পেরেছি ৫০ বছর পূর্তিতে সেই হিসাবটাই আগে করা উচিৎ। আমি কোনো রাজনৈতিক নই,দেশের কোনো বিশেষ বিশেষজ্ঞও নই,একজন অতি সাধারণ নাগরিক। আমি আমার সীমিত জ্ঞান
ও অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,স্বাধীনতা যুদ্ধে
আমাদের বিসর্জনের তুলনায় অর্জন অনেক হলেও যথেষ্ট বা কাঙ্ক্ষিত হয় নি।শিক্ষা,অর্থনীতি,শিল্প,অবকাঠামো ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি অনেক হয়েছে।উন্নত জীবনযাত্রার
মানও আমাদের কম হয় নি। কিন্তু রাজনীতি ও সংস্কৃতির উন্নয়ন, অসাম্প্রদায়িক চেতনা,দুর্নীতি দমন,সুশিক্ষা, আইনের শাসন ও জবাবদিহিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠায়
আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে রয়েছি,স্বাস্থ্যসেবায়
আমরা এখনো অনগ্রসর।
বিগত ৫০ বছরে আমরা এমন একটি রাজনৈতিক কাঠামো
গড়ে তুলতে পারি নি যা দেশকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভয়াবহতা থেকে মুক্ত করতে
পারে।গণতন্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল স্প্রিড,কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক চর্চা আমরা প্রত্যক্ষ
করি না।নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন ছিল মোদের প্রাণের দাবি,কিন্তু স্বাধীন কমিশন করেও এখনো তা
মেরুদন্ডহীন।সাম্যবাদ মূলমন্ত্র হলেও অসাম্য দেখা যায় সমাজের স্তরে স্তরে।বিশেষকরে
পুঁজিবাদের বিকাশ ব্যাপকহারে হওয়ায় সম্পদ চলে গেছে একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে।আর এর
জন্য কোনো একক দল বা সরকার দায়ী নয়,দায়ী আমাদের
রাজনৈতিক সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর থেকে যখন যারা ক্ষমতায় এসেছে সকলেই নিজেদের
রাজনৈতিক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে,আর ভিন্নমতকে দমন-পীড়ন করে দাবিয়ে দিতে
চেয়েছে।আমাদের রাজনীতিতে সহনশীলতা নেই, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নেই।রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও পেশীশক্তির প্রসার দেশকে
অশান্তিময় করে তুলছে। কঠোরভাবে দুর্নীতি দূর করতে না পারা,আমলাতন্ত্রের উপর অধিক নির্ভরশীলতা আমাদের
রাজনীতিবিদদের অদক্ষ করে তুলছে।তাই আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো মেরুদণ্ড
সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি।আশঙ্কা হচ্ছে আর কতোদিন আমাদের পরের প্রজন্মকে এর দায়
কাঁধে নিয়ে বেড়াতে হবে তার ঠিক নেই।যদি নতুন প্রজন্ম থেকে আবার এমন কোনো
ক্যারিশমাটিক নেতৃত্ব সৃষ্টি হয় সেদিন হয়তো জাতি নতুন আলোর পথ দেখবে।বঙ্গবন্ধুর
কাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলাদেশ হয়তো তখন সৃষ্টি হবে।জাতি সেই কাঙ্ক্ষিত নতুন নেতৃত্বের
জন্যই অপেক্ষা করছে।
আর সাংস্কৃতিক বিষয়ে বলতে গেলে বলা যায়,একটি জাতির সংস্কৃতি একবছর বা এক যুগে তৈরি হয়
না, হাজার বছর ধরে গড়ে উঠে
একটি জাতির সংস্কৃতি।পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা চেয়েছিল আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস
করে তাদের সংস্কৃতি এদেশে চালু করতে, কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিকর্মীরা জীবন দিয়ে তা রক্ষা করেছেন।আজ আমাদের নিজস্ব
সংস্কৃতির অনেক কিছুই আমরা হারাতে বসেছি।আমাদের মূল্যবোধে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠছে
না। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও
মূল্যবোধ ।বাঙালিয়ানা সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ
বিসর্জন দিয়ে এখন আমাদের নতুন প্রজন্ম বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে
পড়েছে।এখন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে আর দেশীয় প্রথার প্রচলন খুব একটা দেখা যায়
না।এখন পারিবারিক আদবকায়দা ছেলেমেয়েরা ভুলতে বসেছে।আধুনিক শহুরে সভ্যতা প্রতিনিয়ত
গ্রাস করছে আমাদের হাজার বছরের গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতিকে।তাই বিশ্বে জাতি
হিসেবে আমরা এখনো পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারি নি।এখনও প্রবাসে আমাদের
কর্মীরা নিম্ন শ্রেণির কাজে লিপ্ত থাকে,বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। তবে বিশ্বের অনেক দেশে সুনামও কুড়িয়েছে
বাঙালি জাতি,দেশের পতাকাকে
সমুজ্জ্বল প্রদীপের আলোয় আলোকিত করেছে নিজের দক্ষতা দিয়ে।তাই স্বাধীনতার এই
সুবর্ণজয়ন্তী তথা মুজিববর্ষে আমাদের শপথ নিতে হবে যে,শতবর্ষে গিয়ে আমরা একটি সম্মৃদ্ধ দেশ ও জাতি
গড়তে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষা- সংস্কৃতির প্রবৃদ্ধি বাড়াব,স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী
করব, রাজনীতির গুণগতমান বাড়াব,দুর্নীতিবাজ ও
অপরাধী যেই হোক কঠোরভাবে দমন করব,যেকোনো মূল্যে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ব- এটাই হোক এদিনের মূল অর্জন।