ভালোবাসার হৃদস্পন্দন
ভালোবাসার হৃদস্পন্দন
-হোসনেয়ারা বেগম
রাত আনুমানিক দুটো কি তিনটে।হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় রহমান সাহেবের।এতো রাতে কে হতে পারে, দরজা খুলবে কি খুলবে না দ্বিধা দ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। স্ত্রী সাজেদা চৌধুরী মারা যাওয়ার পর থেকে একাই থাকেন এই ফ্ল্যাটে। দিনে কাজের লোক দুই জন আর ড্রাইভার রমিজ প্রায় সারাক্ষণ থাকে, রাত্রে ওরা চলে যায়।আচ্ছা নিচে তো দারোয়ান বশির থাকে,এতো কিছু না ভেবে ওকে ইন্টারকমে ফোন করে নিলেই হয়।দরজায় আবার শব্দ , এবার শুনা যাচ্ছে মেয়েলি কণ্ঠ, দরজাটা একটু খুলুন দয়া করে, আমার খুব বিপদ,কয়েক বার ফোন দিয়ে ও কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেলনা দারোয়ানের। এদিকে ক্রমশ দরজায় কড়া নাড়ছে আগন্তুক। ও আচ্ছা রহমান সাহেবের পরিচয় তো দেয়া হয় নাই।উনি রিটায়ার্ড জজ ।তার দুই মেয়ে এক ছেলে, সবাই একে একে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে।মেয়ে দুটোর একজন ক্যানাডা ফ্যামিলিসহ এবং ছেলে আর এক মেয়ে ফ্যামিলিসহ সুইজারল্যান্ড। তাদের মা যখন মৃত্যু শয্যায়, সন্তানদের দেখার জন্য তার কী করুন আর্তনাদ! এখনো তার কানে বাঁধে, তখনও তাদের সময় ছিলো না, মৃত্যুর পরও তাদের সময় হয় নাই দেশে আসার। মেয়ে দুটো মাঝে মধ্যে ফোন করে, ছেলে ছেলের বউয়ের সময় মোটেই নাই, নিজ থেকে যদি কখনো ফোন করে বিরক্ত হয়ে বলে বাবা আমরা খুব ব্যস্ত।তুমি বোঝার চেষ্টা কর, তুমি যদি ভালো মনে কর সব ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আস।আমাদের আর দেশে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নাই।এদিকে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ বেঁজেই যাচ্ছে, এক মুহূর্ত ভেবে দরজা খুলে দিলেন তিনি।হতবাক ও আশ্চর্য হলেন রহমান সাহেব। অষ্টাদশী এক তরুণী, কিছু বলার আগেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, নিজেই দরজা আটকিয়ে দিল।রহমান সাহেবের কাছে মনে হলো হিংস্র বাঘের তাড়ানো কোন হরিণী যেন থরথর করে কাপছে,তার চোখ দুটো যেনো কোঠর থেকে বেড়িয়ে পড়বে।রহমান সাহেব নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন কে তুমি মা? কেনোইবা এখানে এভাবে আসছো?বাবা আমি একটি ছেলেকে ভালোবেসে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসছি, কিন্তু আমি বুঝতে পারি নাই সে একটা প্রতারক মিথ্যাবাদী,মানুষরুপী শয়তান। সে আমাকে এনে খারাপ জায়গায় বিক্রি করে দেয়।আমি বুজতে পেরে পালিয়ে আসি, ওরা আমার পিছু নিয়েছিল।এদিকে দারোয়ান ঘুমে থাকায় গেট খোলা ছিল বলে এখানে চলে আসি। রহমান সাহেব কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটি তার পায়ের উপর পড়ে যায়। বাবা আমাকে বাঁচান,রহমান সাহেবের কি যেন হলো,তিনি যেনো অনুভব করলেন,তার মেয়ে নীলু তার পাঁয়ের উপর, কতো বছর পর বাবা ডাক শুনলেন।দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, দেখ আমি একাই থাকি এখানে,তুমি আমাকে ঠিকানা দিও, আমি তোমাকে তোমার বাবা মার কাছে দিয়ে আসব।মেয়েটি বলল,আমার বাবা নাই, ঘরে সৎ মা আছে। সেখানে ও ফিরে যাবার পথ এখন নাই।সেই থেকে সাজু রয়ে গেল রহমান সাহেবের মেয়ে হয়ে।আজ ছয় সাত বছর পেড়িয়ে গেছে তিনি ভুলেই গেছেন সাজু তার মেয়ে নয়।সাজুও প্রাণ দিয়ে সেবা করে যাচ্ছিল তার বাবার।আজ রহমান সাহেব খুবই অসুস্থ। তাই ভাবছেন,উনি মরে গেলে তার সাজুর কি হবে?তাই উকিল ডেকে উত্তরার ফ্ল্যাটটি ওর নামে দিয়ে ড্রাইভার রমিজকে বলছেন, ওর জন্য একটা ভালো ছেলে খুঁজতে।কিন্তু বিধাতার বিধান কে খন্ডায়, রহমান সাহেব হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। এবার ছেলে মেয়েদের সময় হয়েছে ঠিকই।তারা সবাই বসেছে বাবার মিলাদে কি কি মেনু হবে এবং মিলাদের পরে বাবার সহায় সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা কিভাবে হবে।শুধুমাত্র কোন উচ্ছ্বাস নাই সাজুর, সে নির্বাক হয়ে বসে আছে ঘরের এক কোনে।ছোট মেয়ে নীলু বলছে ভাইয়া উত্তরার ফ্ল্যাট আমার খুব পছন্দ, তাই ওটা আমার চাই।ড্রাইভার রমিজ যখন বলে সাহেব ওটা সাজুকে দিয়ে গেছেন তখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে ছেলেমেয়েরা। কোথাকার কোন কাজের মেয়ে তাকে ফ্ল্যাট? প্রশ্নই আসে না, বড়ো জোড় কিছু টাকা সাহায্য করে ওকে বিদায় করা হবে। সাজুর ওদিকে কোনো খেয়াল নাই, সে নির্বাক নির্লিপ্ত হয়ে হেটে যাচ্ছে রহমান সাহেবের কবরের উদ্দেশ্যে। সে যে সত্যিকার অর্থেই বাবাকে হারিয়েছে, ওখানেই আছে তার হৃদস্পন্দন।